প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপকরণাদির কার্যকর ব্যবহারের প্রয়াস বা প্রক্রিয়াকেই ব্যবস্থাপনা বলে । প্রক্রিয়া বলতে পরস্পর নির্ভরশীল ধারাবাহিক কাজের সমষ্টিকে বুঝায় । যার প্রতিটা কাজ প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ ফল দিতে পারে না । একইভাবে কাজগুলো ধারবাহিকভাবে সম্পাদিত না হলে তাথেকেও কার্যকর ফললাভ অসম্ভব । যদি আমরা চিনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার কথা ধরি- তা হলে দেখা যাবে এর কাজগুলো ধারাবাহিক ও পরস্পর নির্ভরশীল নিম্নে সংক্ষেপে তা দেখানো হলো :
উল্লেখ্য এই প্রক্রিয়ার প্রতিটা ধাপ সুচারুভাবে সম্পাদিত হলেই সম্পূর্ণ চিনি পাওয়া সম্ভব । এর কোনো কাজে বিচ্যুতি ঘটলে প্রকৃত ফল অর্থাৎ সম্পূর্ণ চিনি পাওয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে প্রতিটা কাজ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং তা ধারাবাহিকতা মেনে সম্পন্ন হয়। ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াতেও এমন কতকগুলো কাজ আমরা দেখতে পাই যা পরস্পর নির্ভরশীল ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সম্পন্ন হয়ে থাকে । প্রক্রিয়ার কাজগুলো নিমে রেখাচিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো :
ব্যবস্থাপনা বিশারদগণ ব্যবস্থাপনার এ কাজ বা কর্ম প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন । তার কতিপয় ছকের সাহায্যে নিম্নে তুলে ধরা হলো :
বিশেষজ্ঞের নাম | ব্যবস্থাপনা কার্যাবলি |
১. হেনরি ফেয়ল | পূর্বানুমান ও পরিকল্পনা, সংগঠন, আদেশদান, সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণ । |
২. অইরিক ও কুঞ্জ | পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ । |
৩. এল. গুলিক | পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, সমন্বয়সাধন, রিপোর্ট প্রদান ও বাজেট প্রণয়ন। (সংক্ষেপে-POSDCORB : P= Planning; O = Organizing; S = Staffing; D = Directing; Co = Co-ordinating; R = Reporting; B = Budgeting.) |
৪. আরনেস্ট ডেল | পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভাবন ও উপস্থাপন । |
৫. হিস ও গুলেট | সৃষ্টিকরণ, পরিকল্পনা, সংগঠন, প্রেষণা, যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ । |
ছকে উল্লেখ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার প্রধান কার্যাবলি নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. পরিকল্পনা (Planning): ভবিষ্যতে কী করা হবে তা আগাম ঠিক করাকেই পরিকল্পনা বলে । ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার প্রথম কাজ হলো পরিকল্পনা । এটি ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজের ভিত্তিস্বরূপ । পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ ধারাবাহিকতা মেনে সম্পন্ন হয় । তাই পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যবস্থাপকগণকে অত্যন্ত সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে । শুধু কী করা হবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকেই পরিকল্পনা হিসেবে না দেখে কখন ও কোথায় করা হবে, কত সময়ের মধ্যে করতে হবে, কে বা কারা তা সম্পাদন করবে ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। তবেই তা একটা আদর্শ পরিকল্পনা বিবেচিত হয় । ধরা যাক, কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা বনভোজন অনুষ্ঠিত হবে । অধ্যক্ষ স্যার একটা কমিটি করে দিলেন । কমিটিকে এক্ষেত্রে বনভোজনের তারিখ, স্থান, যাওয়ার উপায়, খাবারের মেন্যু, চাঁদার পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রিম . সিদ্ধান্ত নিতে হবে । এর সবটাই পরিকল্পনা হিসেবে গণ্য ।
২. সংগঠন (Organizing) : গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উপকরণাদিকে সংগঠিত ও কাজে লাগানোর উপযোগী করাকেই সংগঠন বলে। ইট, বালি, সিমেন্ট, রড ইত্যাদি যখন আলাদা থাকে তখন তা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না । এই উপকরণগুলোকে যখন একত্রিত করে নির্মাণের কাজে লাগানো হয় তখন তা
থেকে বিল্ডিং, সেতু ইত্যাদি নির্মিত হয় । মানুষগুলো যখন আলাদা-আলাদা থাকে তখন তাদের দ্বারাও কিছু সৃষ্টি হয় না । কিন্তু যখন কাজ ভাগ করে তা মানুষগুলোকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, একের সাথে অন্যের সম্পর্ক বলে দেয়া হয় তখন এই মানুষগুলো একটা সংগঠনে রূপায়িত ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে । তাই উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজকে বিভাজন, প্রতিটা কাজের জন্য দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণ এবং সে অনুযায়ী
উপায়-উপকরণকে সংহত করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট করার কাজকে সংগঠন বলা হয়ে থাকে ।
৩. কর্মীসংস্থান (Staffing) : প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য ও দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মী সংগ্রহ, নির্বাচন, নিয়োগ ও উন্নয়নের কাজকেই কর্মীসংস্থান বলে । সংগঠন প্রক্রিয়ায় কাজ এবং প্রতিটা কাজের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্ধারণের পর ঐ কাজ সম্পাদনের জন্য যোগ্য জনবল সংস্থানের প্রয়োজন পড়ে । এই জনবলের যোগ্যতা, আগ্রহ ও আন্তরিকতার ওপর প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে। তাই কর্মী নিয়োগে ভুল করলে প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে তার কুফল ভোগ করতে হয়। ধরা যাক, কলেজের গেটের জন্য যোগ্য নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন । এক্ষেত্রে এ ধরনের কর্মীর উচ্চতা, বয়স, বুকের মাপ, সুস্থতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, সাহস ইত্যাদি বিষয় দেখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যদি দুর্বল ও রোগগ্রস্ত লোক নিয়োগ দেয়া হয় তবে তার নিকট থেকে উপযুক্ত সার্ভিস কখনই প্রত্যাশা করা উচিত নয় । তাই কোথায়, কোন মানের, কি সংখ্যক লোকের প্রয়োজন সে অনুযায়ী যোগ্য কর্মী নিয়োগ করতে হয় ।
৪. নেতৃত্ব / নেতৃত্বদান (Leading) : কোনো দল বা গোষ্ঠীর আচরণ ও কাজকে লক্ষ্যপানে এগিয়ে নেয়ার কৌশলকেই নেতৃত্ব বলে । যিনি বা যারা এরূপ প্রয়াস চালান তাকে বা তাদেরকে নেতা বলা হয়ে থাকে । নেতৃত্ব দানের বিষয়টি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ । প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের জন্য আদেশ দেয়া, পরিচালনা করা, প্রভাবিত করা, উৎসাহিত করা, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করা, দলগত প্রচেষ্টা জোরদার করা ইত্যাদি বিষয় এর সাথে সম্পৃক্ত । তাই ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনা, প্রেষণা ও সমন্বয় কাজ নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত বলেই গণ্য হয় । সেজন্য আমেরিকান বইগুলোতে ব্যবস্থাপনার কাজ উল্লেখ করতে যেয়ে পরিকল্পনা, সংগঠন, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ- এভাবে কাজের পরম্পরা উল্লেখ করা হয়ে থাকে । অবশ্য এখন অনেকেই পরিকল্পনা সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ— এ পাঁচটি কাজকে ব্যবস্থাপনার কাজ হিসেবে গণ্য করেন। নিম্নে নেতৃত্বের আওতাধীন ব্যবস্থাপনার কাজসমূহ উল্লেখ করা হলো :
ক. নির্দেশনা (Directing) : অধস্তন জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান, তত্ত্বাবধান, উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান এবং অনুসরণ (Follow-up) কার্যকে নির্দেশনা বলে। যোগ্য জনবল কোথাও থাকলেই তারা কাজ করবে এমন প্রত্যাশা করা যায় না । কী কাজ করবে এ বিষয়ে সময়ে সময়ে আদেশ-নির্দেশ প্রদান করতে হয় । তারা সঠিকভাবে কাজ করছে কি না বা করতে পারছে কি না তা তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে অনুসরণ (Follow) করতে হয় । একটা কারখানায় সপ্তাহে ১০০ একক পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হলো । এখন যদি এক সপ্তাহ পর খোঁজ-খবর নেয়া হয় কাজ কী হয়েছে? তবে দেখা যাবে কাজ পুরোটা হয়নি। অধস্তনরা নানান সমস্যার কথা বলবে, কারণ দর্শাবে। এক্ষেত্রে যদি উর্ধ্বতন প্রতিদিনের কাজের খোজ-খবর নিতেন, সমস্যা দেখা দিলে সেভাবে পরামর্শ বা নির্দেশনা দিতেন, পুরো সপ্তাহের কাজ সেভাবে দেখা হতো তবে কার্যফল আরও আশাব্যঞ্জক হতে পারতো ।
খ. প্রেষণা (Motivation): অধস্তন কর্মীদের কাজের প্রতি অনুপ্রাণিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করার কাজকে প্রেষণা বলে । কর্মীদের কোনো কাজ করতে বললেই তারা সবসময় আন্তরিকতা নিয়ে সম্পাদন করবে এটা আশা করা যায় না। যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য বস্তুগত উপকরণের সাথে জনশক্তির এখানেই বড় পার্থক্য বিরাজমান । জনশক্তি যদি কাজে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত না হয় তবে তাদের যতই আদেশ-নির্দেশ প্রদান করা হোক, তত্ত্বাবধান করা হোক তা কখনই কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারে না। ভীতি প্রদর্শন বা কাজে চাপ সৃষ্টি করলে স্বল্প সময়ের জন্য কখনও কিছুটা ভাল ফল লক্ষ করা গেলেও বাস্তবে তা কার্যকর নয়। তাই ব্যবস্থাপনার পক্ষ থেকে কর্মীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে কাজ আদায় এবং প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখার কাজ বর্তমানকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এজন্য আর্থিক ও অনার্থিক বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে ।
গ. সমন্বয়সাধন (Coordination) : বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগের কাজকে একসূত্রে গ্রথিত ও সংযুক্ত করার কাজকে সমন্বয় বলে । একটা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগ কাজ করে । প্রতিটা ব্যক্তি ও বিভাগ যদি নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে, অন্যের সাথে নিজের কাজের সমন্বয় বা সংযুক্তির বিষয়টি না ভাবে তবে দেখা যাবে এক পর্যায়ে সামগ্রিক কাজে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। তাই সম্মিলিত যে কোন কাজে সকল ব্যক্তি ও বিভাগকে প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য অর্জন বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজন পড়ে। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব উর্ধ্বতন নেতৃত্বের । উৎপাদন বিভাগ যদি ইচ্ছামতো উৎপাদন করে এবং বিক্রয় বিভাগ তার সাথে তাল মিলিয়ে বিক্রয় করতে ব্যর্থ হয় তবে এক পর্যায়ে মজুত পণ্য অবিক্রিত থাকবে এবং তা সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করবে ।
৫. নিয়ন্ত্রণ (Controlling): পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের কার্যাদি সম্পন্ন হয়েছে কি না তা পরিমাপ, বিচ্যুতি ঘটলে তার কারণ নির্ণয় ও বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বলে। প্রতিষ্ঠানের যে কোনো কাজ শুরুর পূর্বে পরিকল্পনা প্রণীত হয় । তার আলোকে উপায়-উপকরণাদিকে সংহত করা হয়ে থাকে । এরপর অধস্তনদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও প্রেষণা দেয়া হয়। কার্য চলাকালে বিভিন্ন বিভাগের কাজে সমন্বয়সাধন করা হয়। এরপর সময় শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা সম্পন্ন হয়েছে তা মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে । এতে ব্যবস্থাপনা কার্য কতটা দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়েছে তার প্রমাণ মেলে । ধরা যাক, একটা প্রতিষ্ঠান তিন মাসে ১০,০০০ একক পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ের পরিকল্পনা নিয়েছিল। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ পরিচালিত হয় । তিন মাস পর অবশ্যই দেখতে হবে যে, কতটা ফল অর্জিত হয়েছে এবং বিচ্যুতি হলে কেন তা ঘটেছে। যাতে পরবর্তী পরিকল্পনার মাধ্যমে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এতে ব্যবস্থাপনার জবাবদিহিতা ও কার্যদক্ষতার মান বৃদ্ধি পায় । উল্লেখ্য, এ সময়কাল দিন, সপ্তাহ, মাস বা বছরও হতে পারে ।